বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় — বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। এটি শুধু বাংলাদেশেরই নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীন সভ্যতা ও ইতিহাস সংরক্ষণের এক অমূল্য সম্পদ। দর্শনপ্রিয়, ইতিহাসমনস্ক ও গবেষকদের কাছে এটি এক অবিস্মরণীয় স্থান। বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থান, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্য সম্পর্কে আরও জানতে আমাদের সাইটের সঙ্গে থাকুন।

বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর

 

বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর

 

অবস্থান ও পরিচিতি

বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর (Varendra Research Museum) অবস্থিত রাজশাহী মহানগরের হেতেম খাঁ এলাকায়, শহরের একেবারে কেন্দ্রস্থলে। এটি বাংলাদেশের প্রথম প্রতিষ্ঠিত জাদুঘর এবং প্রত্নসংগ্রহের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগার ও প্রদর্শনকেন্দ্র। বর্তমানে এটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে।

 

গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

ইতিহাস ও প্রতিষ্ঠা

এই ঐতিহাসিক জাদুঘরটি ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তখন তিনজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এর যাত্রা শুরু হয় —

  1. নাটোরের দিঘাপাতিয়া রাজপরিবারের জমিদার শরৎ কুমার রায়,

  2. বিশিষ্ট আইনজীবী ও ইতিহাসবিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, এবং

  3. রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক রামপ্রসাদ চন্দ্র

তাঁরা বাংলার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রত্ননিদর্শন সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে “বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি” (Varendra Research Society) গঠন করেন। একই বছরে তাঁরা রাজশাহী ও আশেপাশের এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে ৩২টি দুষ্প্রাপ্য নিদর্শন সংগ্রহ করেন।

 

বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর

 

জাদুঘরের নির্মাণ ও উদ্বোধন

জমিদার শরৎ কুমার রায় তাঁর নিজস্ব জমি দান করেন জাদুঘরের ভবন নির্মাণের জন্য। এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯১১ সালে এবং শেষ হয় ১৯১৩ সালে।
সেই বছরের ১৩ নভেম্বর, ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার তৎকালীন গভর্নর লর্ড কারমাইকেল জাদুঘরটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।

১৯১১ সালে কলকাতা জাদুঘর বরেন্দ্র জাদুঘরের নিদর্শনগুলো নিজেদের বলে দাবি করলে এক সময় সংকট দেখা দেয়। তবে ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরকে পূর্ণ স্বীকৃতি ও নিদর্শন সংরক্ষণের অধিকার প্রদান করা হয়।

প্রত্নতাত্ত্বিক অবদান ও গবেষণা কার্যক্রম

১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে বরেন্দ্র জাদুঘর কর্তৃপক্ষ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে নওগাঁ জেলার পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার খনন কাজ শুরু করে।
পরে বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির একক প্রচেষ্টায় পাহাড়পুর থেকে ২৫৬টিরও বেশি প্রত্ননিদর্শন আবিষ্কৃত হয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রাচীন মূর্তি, পোড়ামাটির ফলক, লিপি, ও স্থাপত্যাংশ।

এই নিদর্শনগুলো বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস, পাল-সেন যুগের শিল্পকলা, ধর্ম, স্থাপত্য ও বৌদ্ধ সংস্কৃতি বোঝার জন্য এক অনন্য উৎস হিসেবে বিবেচিত।

সংগ্রহশালা ও প্রদর্শনী

বর্তমানে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে প্রায় ১৫,০০০-এরও বেশি প্রত্নবস্তু সংরক্ষিত আছে।
প্রদর্শনীর মধ্যে রয়েছে—

  • পাল, সেন ও গুপ্ত যুগের মূর্তি,

  • প্রাচীন পাথর ও ধাতুর ভাস্কর্য,

  • মৃৎশিল্প ও টেরাকোটা ফলক,

  • মুসলিম যুগের শিলালিপি, ক্যালিগ্রাফি ও অলঙ্কার,

  • প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, নথি ও ঐতিহাসিক মানচিত্র।

প্রতিটি নিদর্শন শুধু অতীতের কাহিনি নয়, বরং বাংলার ঐতিহ্য ও সভ্যতার সাক্ষ্য বহন করে।

বর্তমান অবস্থা ও গুরুত্ব

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর একসময় জাদুঘরের অস্তিত্ব নিয়ে সংকট দেখা দিলেও পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এটি নিজেদের অধীনে গ্রহণ করে এবং নতুন প্রাণসঞ্চার ঘটায়। বর্তমানে এটি গবেষক, শিক্ষার্থী ও পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত এবং প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ এই জাদুঘর পরিদর্শন করেন।

বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর আজও বাংলাদেশের ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব ও ঐতিহ্যের এক জীবন্ত দলিল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

 

Leave a Comment