বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের সমস্যাসমূহ

বাংলাদেশ—একটি নদীমাতৃক দেশ, যেখানে প্রকৃতি, ইতিহাস ও সংস্কৃতি মিশে গড়ে তুলেছে এক বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যের ভূমি। বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তর, পাহাড়-অরণ্য, হাওর-বাঁওড়, সমুদ্রসৈকত, ঐতিহাসিক মসজিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন—সব মিলিয়ে এটি পর্যটনের জন্য এক অনন্য গন্তব্য। তবুও দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, এই দেশ পর্যটনের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার পর্যটন মানচিত্রে এখনও প্রান্তিক অবস্থানে

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন অপরিসীম, তেমনি এর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও হাজার বছরের পুরোনো। কিন্তু এই ঐশ্বর্যকে পর্যটন সম্পদে রূপ দিতে না পারার পেছনে রয়েছে নানা সমস্যা—অবকাঠামোগত ঘাটতি, প্রচারণার অভাব, নিরাপত্তাহীনতা, নীতিগত দুর্বলতা, এবং জনসচেতনতার অভাব।

 

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের সমস্যাসমূহ

 

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের সমস্যাসমূহ

 

বাংলাদেশের পর্যটনের সারসংক্ষেপ ও গুরুত্ব

পর্যটন শিল্প একটি দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশ্ব পর্যটন সংস্থা (UNWTO)-এর তথ্য অনুযায়ী, পর্যটন বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শিল্পখাত—যা বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ১০% আয় সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশও এই শিল্পের সুফল ভোগ করতে পারে, কারণ এদেশে রয়েছে—

  • বিশ্বের দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত (কক্সবাজার)

  • বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন (সুন্দরবন)

  • প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন যেমন মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, ময়নামতি,

  • নৈসর্গিক পাহাড় ও নদীর শহর রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, সাজেক,

  • এবং সংস্কৃতি, লোকজ ঐতিহ্য ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ গ্রামীণ জীবন।

তবুও এই বিপুল সম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প এখনো একটি অনুন্নত খাত।

 

গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের পর্যটন খাতের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৩ সালে, যখন গঠিত হয় “বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন (BPC)”। এর লক্ষ্য ছিল দেশীয় ও বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করা এবং জাতীয় অর্থনীতিতে পর্যটনকে একটি আয়বর্ধক খাতে পরিণত করা। তবে পর্যাপ্ত পরিকল্পনা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও বেসরকারি অংশগ্রহণের অভাবে এই খাত দীর্ঘদিন ধরে স্থবির রয়ে গেছে।

বর্তমানে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পর্যটন খাত দেশের মোট জিডিপির প্রায় ৩% অবদান রাখে, যেখানে প্রতিবেশী দেশগুলোতে (যেমন থাইল্যান্ডে ২০%, নেপালে ৭%, শ্রীলঙ্কায় ১১%) এই অবদান অনেক বেশি।

 

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের সমস্যাসমূহ

 

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের প্রধান স মস্যাসমূহ

১️⃣ অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা

বাংলাদেশে পর্যটন বিকাশের সবচেয়ে বড় বাধা হলো দুর্বল পরিবহন ও অবকাঠামো ব্যবস্থা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থানে পৌঁছানো যায় না মানসম্মত সড়কপথে। কক্সবাজার বা রাঙ্গামাটিতে যাওয়ার পথও অনেক সময় দুর্ঘটনাপ্রবণ ও সময়সাপেক্ষ। এছাড়া অধিকাংশ পর্যটন অঞ্চলে মানসম্মত হোটেল, রিসোর্ট, পাবলিক টয়লেট, ট্রাভেল ইনফরমেশন সেন্টার, নিরাপদ খাবার ও চিকিৎসা কেন্দ্র-এর ঘাটতি রয়েছে।

২️⃣ পর্যটন ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা

বাংলাদেশে কেন্দ্রীভূত পর্যটন নীতি ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা কাঠামো অনুপস্থিত। বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, যেমন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, পর্যটন কর্পোরেশন, স্থানীয় প্রশাসন—এরা একে অপরের সঙ্গে সমন্বয় না রেখে কাজ করে। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে জটিলতা তৈরি হয় এবং প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের আগেই ব্যর্থ হয়।

৩️⃣ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতা

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ধর্মঘট, অবরোধ, কিংবা হঠাৎ সহিংস ঘটনার কারণে অনেক বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশ সফর থেকে বিরত থাকেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছিনতাই, প্রতারণা, যৌন হয়রানি, দালাল চক্র ও উচ্চমূল্যের পণ্য বিক্রি—যা পর্যটকদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে নারী ও একক ভ্রমণকারীরা অনেক সময় নিরাপত্তা নিয়ে ভয় পান।

৪️⃣ প্রচারণার অভাব

বাংলাদেশের পর্যটন সম্পদ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যথাযথভাবে উপস্থাপিত হয়নি। বিশ্বের বড় বড় ট্যুরিজম ফেয়ার বা প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের উপস্থিতি নিতান্তই নামমাত্র। “Beautiful Bangladesh” ব্র্যান্ডিং শুরু হলেও তা ধারাবাহিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। ফলে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশকে এখনও “Tourist-friendly country” হিসেবে উপস্থাপন করা যায়নি।

৫️⃣ পরিবেশগত অবনতি

অসংগঠিত উন্নয়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব, অবৈধ স্থাপনা ও যানবাহনের ধোঁয়ায় অনেক পর্যটন অঞ্চল ধীরে ধীরে দূষিত হয়ে যাচ্ছে। কক্সবাজার সৈকত, সাজেক ভ্যালি, ও রাঙামাটির কাপ্তাই লেক ইতিমধ্যে পরিবেশগত হুমকির মুখে। পর্যটন এলাকা সংরক্ষণে পরিবেশবান্ধব আইন থাকলেও তার প্রয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে।

৬️⃣ দক্ষ মানবসম্পদের অভাব

একটি উন্নত পর্যটন শিল্পের জন্য প্রয়োজন দক্ষ ট্যুর গাইড, হসপিটালিটি ম্যানেজার, ফুড সার্ভিস কর্মী ও তথ্যদাতা। কিন্তু বাংলাদেশে পেশাগত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পর্যটনকর্মীর সংখ্যা অত্যন্ত কম। ফলে পর্যটকরা প্রত্যাশিত মানের সেবা পান না।

৭️⃣ বিনিয়োগ ও অর্থায়নের ঘাটতি

পর্যটন খাতে পর্যাপ্ত বেসরকারি বিনিয়োগ ও বিদেশি অর্থায়ন নেই। সরকারি বাজেটে পর্যটন বরাদ্দ জিডিপির ১% এরও কম। ফলে অবকাঠামো, রিসোর্ট উন্নয়ন, এবং আন্তর্জাতিক মানের হোটেল নির্মাণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে পর্যটন শিল্পের চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৮ লক্ষ বিদেশি পর্যটক আসেন, যেখানে মালয়েশিয়ায় আসে ২৫ মিলিয়ন, থাইল্যান্ডে ৩৮ মিলিয়ন এবং নেপালে ১.৫ মিলিয়ন পর্যটক। অর্থাৎ, আমাদের অবস্থান এখনো ক্ষুদ্র পর্যায়ে সীমাবদ্ধ। এই খাতের বার্ষিক আয় ৩০০ মিলিয়ন ডলার, যা ভারতের তুলনায় ৫০ গুণ কম।

এর অন্যতম কারণ হলো—নীতি-নির্ধারণে ধারাবাহিকতার অভাব। প্রতিটি সরকার পর্যটন উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে দেখা যায়, নতুন প্রকল্প শুরু হলেও তা মধ্যপথেই বন্ধ হয়ে যায় বা রক্ষণাবেক্ষণ হয় না।

করণীয় ও সম্ভাব্য সমাধান

১. অবকাঠামো উন্নয়ন

পর্যটন অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা করে সড়ক, রেল ও বিমান যোগাযোগ উন্নত করতে হবে। প্রতিটি পর্যটন স্পটে আধুনিক টয়লেট, নিরাপদ পানির ব্যবস্থা, রেস্ট হাউস, রেস্তোরাঁ, ইন্টারনেট ও চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন অপরিহার্য।

২. নিরাপত্তা জোরদার

“ট্যুরিস্ট পুলিশ ইউনিট”-এর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং ২৪ ঘণ্টার হেল্পলাইন সার্ভিস চালু করা উচিত। বিশেষ করে নারী ও বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আলাদা নজরদারি প্রয়োজন।

৩. প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ গঠন

পর্যটন ও হোটেল ব্যবস্থাপনা শিক্ষাকে কারিগরি শিক্ষার অংশ হিসেবে সম্প্রসারণ করা জরুরি। ট্যুর গাইড, রিসোর্ট ম্যানেজার ও ড্রাইভারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া গেলে সেবা মান অনেক উন্নত হবে।

৪. ডিজিটাল ব্র্যান্ডিং ও প্রচার

সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব, অনলাইন ট্রাভেল প্ল্যাটফর্ম (TripAdvisor, Booking.com, Expedia ইত্যাদি)-এ বাংলাদেশের পর্যটন পরিচিতি গড়ে তোলা দরকার। “Beautiful Bangladesh” প্রচারণাকে নতুনভাবে চালু করে দেশীয় ভাষা ছাড়াও ইংরেজি, আরবি, চীনা ও ফরাসি ভাষায় প্রচার করা উচিত।

৫. বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা

বিনিয়োগকারীদের কর রেয়াত, জমি লিজ সুবিধা ও নীতি সহায়তা দিতে হবে, যাতে তারা পর্যটন খাতে আগ্রহী হন। এছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে।

৬. পরিবেশ সংরক্ষণ

সকল পর্যটন অঞ্চলে “ইকো-ফ্রেন্ডলি ট্যুরিজম পলিসি” প্রয়োগ করতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, প্লাস্টিক নিষিদ্ধকরণ, সৌর শক্তি ব্যবহার এবং স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে দায়িত্বশীল পর্যটন গড়ে তোলা সম্ভব।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বাংলাদেশ সরকার “Vision 2041”-এর অধীনে পর্যটন খাতকে একটি অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে ২০৩৫ সালের মধ্যে এই খাত থেকে বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব। এছাড়া “বঙ্গবন্ধু ট্যুরিজম সার্কিট” প্রকল্প, কক্সবাজারে “সোনার বাংলা ট্যুরিজম পার্ক”, এবং “চট্টগ্রাম-সেন্ট মার্টিন মেরিন ট্যুরিজম করিডোর” প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের পর্যটন খাতে নতুন যুগের সূচনা হবে।

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প এক সম্ভাবনার ভাণ্ডার, যার উন্নয়ন কেবল অর্থনৈতিক নয়—সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণও বয়ে আনতে পারে। প্রকৃতি, ঐতিহ্য, আতিথেয়তা—সবকিছু আমাদের রয়েছে, প্রয়োজন কেবল দক্ষ ব্যবস্থাপনা, আন্তরিকতা ও টেকসই নীতি বাস্তবায়ন

যদি সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বে পরিকল্পিতভাবে কাজ করা যায়, তবে বাংলাদেশ একদিন বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্যে পরিণত হবে— যেখানে সুন্দরবনের নিসর্গ, কক্সবাজারের তরঙ্গ, পাহাড়পুরের ইতিহাস, আর বাংলার মানুষের হাসি মিলেমিশে গড়বে “Beautiful Bangladesh”-এর প্রকৃত রূপ।

 

Leave a Comment