সংগ্রামপুঞ্জি জলপ্রপাত (Songrampunji Waterfall) কেউ বলে সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্না কেউ কেউ সেনগ্রামপুঞ্জি ঝরনা। স্থানীয় আরেকটি নাম মায়াবী ঝর্ণা। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র ১৫-২০ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে অবস্থিত এ জলপ্রপাতটি ভারতের সীমান্তে পড়েছে। তবে বিএসএফের প্রহরায় চায়লেই বাংলাদেশীরা এ জলপ্রপাতের চূড়া পর্যন্ত উঠতে পারে। কয়েক ধাপবিশিষ্ট এমন জলপ্রপাত বাংলাদেশে কমই দেখতে পাওয়া যায়।
সংগ্রামপুঞ্জি পরিচিতি
বর্ষায় সিলেট যেন তার রূপের বিচিত্র পসরা সাজিয়ে সবাইকে আমন্ত্রণ জানায় বাংলার অপার সৌন্দর্য দেখার। সবুজ চা বাগান, পাহাড়, জলপ্রপাত, ঝর্ণা আর পিয়াইন নদী সহ ছোট-বড় কয়েকটি পাহাড়ি নদী নিয়ে সিলেট যেন কোনো রূপকথার দেশ। এই সিলেটের অপূর্ব প্রাকৃতি সম্ভারের অন্যতম পর্যটন গন্তব্য হল সংগ্রামপুঞ্জি জলপ্রপাত।
এই জলপ্রপাতের অপর পাশে ভারতের ডাওকি অঞ্চলের পাহাড়সারি। এখানে পাহাড়, জলপ্রপাত এবং নদীর সম্মিলন স্থানটিকে পর্যটকদের নিকট আকর্ষনীয় করে তুলেছে।
জাফলংয়ের বল্লা, সংগ্রামপুঞ্জি, নকশিয়াপুঞ্জি, লামাপুঞ্জি ও প্রতাপপুর জুড়ে রয়েছে ৫টি খাসিয়াপুঞ্জী। জলপ্রপাতটি সংগ্রামপুঞ্জিতে অবস্থিত বলে এটি সংগ্রামপুঞ্জি জলপ্রপাত নামে সমধিক পরিচিত। তবে কখনো কখনো একে সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা, সংগ্রামপুঞ্জি ঝরনা, সেনগ্রামপুঞ্জি ঝরনা, সংগ্রামপুঞ্জির মায়াবী ঝর্ণা কিংবা মায়াবী ঝর্ণা নামেও উল্লেখ করা হয়।
সংগ্রামপুঞ্জির আকর্ষণ
সংগ্রামপুঞ্জি জলপ্রপাতের উৎস হলো প্রতিবেশী ভারতের সীমান্ত-অভ্যন্তরে থাকা ডাউকির উঁচু পাহাড়শ্রেণী থেকে নেমে আসা একটি জলপ্রপাত। পর্যটকদের মূল আকর্ষণ! ভারত সীমান্তে জলপ্রপাতটি বিএসএফের পাহারায় বাংলাদেশিরা চূড়া পর্যন্ত উঠতে পারেন। সংগ্রামপুঞ্জি জলপ্রপাতের মূলত তিনটি ধাপ। শেষ ধাপে রয়েছে একটী রহস্যময় সুড়ঙ্গ! ঝর্ণা বেয়ে উপরে উঠা খুব ঝুঁকিপূর্ণ একটি কাজ। পানির স্রোতের কারণে ঝর্ণার গা সবসময় পিচ্ছিল থাকে। তাই পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলে জলপ্রপাতের উপরে উঠার চেষ্টা না করাই ভালো। নিচ থেকেও চমৎকার ভাবে এই ঝর্ণাটি দেখা যায়।
মৌসুমি বায়ুপ্রবাহে বর্ষাকালে প্রবল বৃষ্টিপাতে প্রাণ ফিরে পায় কয়েক ধাপবিশিষ্ট জলপ্রপাতটি, আর হয়ে ওঠে জলে টইটম্বুর। বর্ষাকালে সৌন্দর্যপ্রেমী সবার সমাগমে মুখরিত হয়ে ওঠে প্রপাতটি। তাছাড়া পাহাড়ের মাথায় মেঘের দৃশ্যও যথেষ্ট মনোরম। বৃষ্টির সময় মেঘ, বৃষ্টি, পাহাড়, নদীর স্বচ্ছধারা এক অপার্থিব মায়াবী সৌন্দর্যের অবতারণা করে। তাই অনেকে কাছে এটি মায়াবী ঝর্ণা নামেও পরিচিত।
খানিকটা দূর থেকেই জলপ্রপাতটির পাহাড় বেয়ে নেমে আসা পানির গর্জন কানে আসে। সামনে যেতেই চোখে পড়ে গাছ, পাথর আর পানির অপূর্ব মেলবন্ধন। পাহাড়ের গা-বেয়ে বেশ কয়েকটি ধারায় নেমে আসছে ফেনিল সাদা পানির স্রোত। কখনো সবুজ ঝোপের ভেতর দিয়ে, কখনোবা নগ্ন পাথরের বুক চিরে নেমে আসে এ ধারা। ঝরনার পানি এসে জমা হয়ে ছোট্ট পুকুরের মতো সৃষ্টি হয়েছে নিচে, যার তিন দিকেই রয়েছে বড় বড় পাথরের চাই। জলপ্রপাতের পানির স্বচ্ছতাও এর আকর্ষণের অন্যতম কারণ
চাইলে সেই শীতল জলে ডুব দিতে পারেন কিংবা করতে পারেন চূড়ায় ওঠার অ্যাডভেঞ্চার। ঝরনার তৃতীয় ধাপ থেকে কিছু পানি নিচে গড়িয়ে পড়ে, আর কিছু চলে যায় বাম দিকের সুড়ঙ্গে। সুড়ঙ্গমুখের কিছুটা অংশ পর্যন্ত দৃষ্টি চলে, বাকিটা অন্ধকার। সুড়ঙ্গ পথের কোনো হদিস কারো জানা নেই। ঠাঁই পাওয়া যায় না বলে ওই পথে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রকৃতিকন্যা জাফলংয়ের কাছেই হাতছানি দিয়ে প্রকৃতিপ্রেমীদের ডাকছে মায়াবী ঝর্ণা।
সংগ্রামপুঞ্জি কোথায় অবস্থিত?
সংগ্রামপুঞ্জি জলপ্রপাত বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার অন্তর্গত একটি জলপ্রপাত। সিলেট শহর থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে, ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে জাফলং জিরো পয়েন্ট থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত সংগ্রামপুঞ্জি জলপ্রপাত।
কখন যাবেন সংগ্রামপুঞ্জি?
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে সারা বছরই ভ্রমণ পিপাসুরা ছুঁটে যায় এখানে। তবে শীতকালে এখানে তেমন পানি থাকেনা। তাই মায়াবী ঝর্ণার আসল রূপ দেখতে চায়লে যেতে হবে বর্ষাকালে। এক কথায় বলা যায় বর্ষা মৌসুমে অথবা বর্ষা পরবর্তী সময়টা সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। অর্থাৎ জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত।
কিভাবে সংগ্রামপুঞ্জি যাওয়া যায়?
সিলেট জেলা শহর থেকে তামাবিল মহাসড়কে জাফলংয়ের দূরত্ব মাত্র ৫৬ কিলোমিটার, গোয়াইনঘাট উপজেলা সদর হতে সারিঘাট হয়ে ৩২ কিলোমিটার এবং রাধানগর হয়ে ১২ কিলোমিটার।
সিলেট থেকে জাফলং
সিলেট থেকে আপনি বাস/ মাইক্রোবাস/ সিএনজি চালিত অটোরিকশায় যেতে পারেন জাফলংয়ে। সময় লাগবে ১ ঘণ্টা হতে ১.৩০ ঘণ্টা।
সিলেটে থেকে বাস, মাইক্রোবাস, সিএনজি অটোরিকশা বা লেগুনায় (হিউম্যান হলার) যাওয়া যায় জাফলংয়ে। জাফলং যেতে জনপ্রতি বাস ভাড়া পড়বে ৮০ টাকা। যাওয়া-আসার জন্য মাইক্রোবাসের ভাড়া পড়বে ৩০০০-৩৫০০ টাকা। সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া পড়বে ১০০০-১২০০ টাকা। সিলেট শহরের যে কোনো অটোরিকশা বা মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে যাওয়া যাবে জাফলংয়ে।
জাফলং থেকে সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা
জাফলংয়ে যে নদীটি বয়ে গেছে সেটি পিয়াইন নদী। জাফলং জিরো পয়েন্টে নৌকা ঘাট পাবেন। সেখান থেকে নৌকা দিয়ে নদী পাড়ি দিয়ে যেতে হয় সংগ্রামপুঞ্জিতে। বর্ষাকালে জলপ্রপাতের সামনে পর্যন্ত নৌকা যাতায়াত করলেও শুকনা মৌসুমে বোট থেকে নেমে ১০ থেকে ১৫ মিনিট হাটলেই পাওয়া যাবে সংগ্রামপুঞ্জি জলপ্রপাত।
যাতায়াতের মাধ্যম: বাস, মাইক্রোবাস, জীপ, সিএনজি, ট্যাক্সি ও নৌকা।
কোথায় থাকবেন?
গেষ্ট হাউজ ও রেষ্ট হাউজের তথ্য:
- জেলা পরিষদের রেষ্ট হাউজ, উপজেলা হেড কোয়ার্টার। যোগাযোগ: ইউএনও ০১৭৩০ ৩৩১০৩৬। কেয়ারটেকার: ০১৭৩৭৬৯৬৭৮১।
- নলজুরী রেষ্ট হাউজ- নলজুরী, জাফলং। যোগাযোগ: প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা পরিষদ, সিলেট- ০১৭১১-৯৬৬০১৯, কেয়ারটেকার: ০১৭৫২-২২৬৩৭৫
- গ্রীণ পার্ক রেষ্ট হাউজ, নলজুরী, জাফলং। যোগাযোগ: বিভাগীয় বন কর্মকর্তা, সিলেট- ০১৭১১-১৮০৫৭৪, কেয়ারটেকার: ০১৭৬৬-৮৫৭১৬৮
- সওজ বাংলো, জাফলং- যোগাযোগ- নির্বাহী প্রকৌশলী, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, সিলেট-০১৭৩০ ৭৮২৬৬২।
কোথায় খাবেন?
জাফলংয়ে অবস্থিত রেস্টুরেন্টের মধ্যে জাফলং ভিউ রেস্টুরেন্ট, সীমান্ত ভিউ রেস্টুরেন্ট, পিকনিক সেন্টার রেস্টুরেন্ট, ক্ষুধা রেস্টুরেন্ট এবং জাফলং পর্যটক রেস্টুরেন্ট উল্লেখযোগ্য। সিলেট শহরে খেতে চাইলে জিন্দাবাজার এলাকায় অবস্থিত পানসী, পাঁচ ভাই কিংবা পালকি রেস্টুরেন্টের সুলভ মূল্যে পছন্দমত খাবার খেতে পারবেন।
ভ্রমণকালে পরামর্শ
- কয়েকজন একসাথে গ্রুপ করে গেলে খরচ কম পড়বে।
- সিলেট থেকে জাফলং যেতে গাড়ি ঠিক করার সময় দরদাম করে নিবেন।
- কিছু কিনতে বা খেতে চাইলে দরদাম জেনে নিবেন।
- জাফলংয়ে নদীতে নামার সময় সতর্ক থাকুন, পিয়াইন নদীর পানিতে প্রচুর স্রোত থাকে, সাঁতার না জানলে নদী নামবেন না। সাঁতার জানলেও লাইফ জ্যাকেট পরুন।
- সংগ্রামপুঞ্জি ভ্রমণের সেরা সময় বর্ষাকাল। বর্ষাকালে এই জলপ্রপাত পূর্ণ যৌবণা। এডভেঞ্চারের নেশায় ঝর্ণায় উঠতে গিয়ে অসতর্ক হয়ে পড়লে যেকোনো দূর্ঘটনা ঘটতে পারে।
- পিচ্ছিল পাথর আর পানি টপকে উপরে উঠতে দরকার সতর্কতা আর অবশ্যই ভালো গ্রিপের জুতা।
- নৌকা নেওয়ার সময় দরদাম করে নিন। ছুটির দিনে সব কিছুর দাম বেড়ে যায়, তখন ভ্রমণে খরচ বেশি হয়।
- মনে রাখা দরকার পিয়াইন নদী পার হয়ে ৫ মিনিট হাঁটার পরই আপনার মোবাইলে আর নেটওয়ার্ক থাকবেনা। কারণ জায়গাটি ভারতের মেঘালয়ের সীমান্তঘেঁষা।
- জাফলং সীমান্তবর্তী এলাকা, তাই সীমান্ত এলাকার নির্দেশনা মেনে চলুন।
- জাফলংয়ে অনেক ভারতীয় পণ্যের দোকান পাবেন। বেশিরভাগই নকল, তাই কিছু কিনতে চাইলে সাবধানে কিনতে হবে।
- স্থানীয়দের সাথে ভালো ব্যবহার করুন।
- প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি করে এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকুন।
গ্যালারি
আশেপাশের আকর্ষণ