একদিনে বান্দরবান ভ্রমণ সম্ভব নয়! ভৌগোলিক কারণেই বান্দরবানে অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। তবে একদিনেই বান্দরবানের ৫ স্পট ভ্রমণ করাটা সম্ভব। এই অঞ্চলের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য কমপক্ষে ৫-৬ দিন সময় প্রয়োজন।
পাহাড়, নদী ও ঝর্ণার মিলনে অপরূপ সুন্দর এই পার্বত্য জেলা। বাংলাদেশের এই নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলা ভূমির অপার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় না এমন মানুষ খুব কমই আছে।
বান্দরবান জেলার দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে বাকলাই ঝর্ণা, বগা লেক, বুদ্ধ ধাতু জাদি, চিম্বুক পাহাড় রেঞ্জ, চিনরি ঝিরি ঝর্ণা, ফাইপি ঝর্ণা, জাদিপাই ঝর্ণা, কেওক্রাডং, মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স, মিরিংজা পর্যটন, নাফাখুম, রেমাক্রি, নীলাচল, নীলগিরি, থানচি, পতংঝিরি ঝর্ণা, প্রান্তিক লেক, রাজবিহার, উজানিপারা বিহার, রিজুক ঝর্ণা, সাঙ্গু নদী, শৈল প্রপাত, তাজিংডং, উপবন পর্যটন কেন্দ্রসহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। কিন্তু আপনি চাইলে এর মধ্যে ৪টি ভ্রমণ স্পট একদিনেই ঘুরে ফেলতে পারেন
একদিনে বান্দরবান ভ্রমণ
একদিনে বান্দরবান ভ্রমণ করার জন্য শৈলপ্রপাত, নীলগিরি, চিম্বুক, নীলাচল, মেঘলা এসব জায়গা যাওয়ার জন্য চান্দের গাড়ি ভাড়া নিতে হবে। একটি চান্দের গাড়িতে ১২-১৪ জন যাওয়া যায়। প্রতিটি চান্দের গাড়ির ভাড়া ৩,০০০-৫,০০০ টাকা। চায়লে প্রাইভেট কার বা বেবি ট্যাক্সিও ভাড়া করতে পারেন।
শৈল প্রপাত ঝর্ণা

প্রথম গন্তব্য হলো শৈল প্রপাত ঝর্ণা। বাংলাদেশের অতি পরিচিত ঝরনাগুলোর মধ্যে শৈলপ্রপাত অন্যতম। এটি বান্দরবান শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে বান্দরবান-রুমা সড়কের পাশে অবস্থিত। পর্যটননগরী বান্দরবানের কাছে হওয়ায় সারা বছরই পর্যটক সমাগমে মুখরিত থাকে স্বচ্ছ ও ঠাণ্ডা পানির এই ঝরনা।
শৈলপ্রপাতে গেলেই চোখে পড়বে বম উপজাতীয়দের জীবনধারা। তাদের হাতে বোনা চাদর, মাফলার, বেডশিটসহ বেত ও বাঁশের তৈরি বিভিন্ন আসবাবপত্র ও তৈজসপত্র সহনীয় মূল্যে পাওয়া যায়। বম নারী-পুরুষেরা শৈলপ্রপাতকে ঘিরে এসব জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসে। বমদের উৎপাদিত মৌসুমি ফলমূল এখানে সবসময় পাওয়া যায়। রাস্তার পাশে শৈলপ্রপাতের অবস্থান হওয়ায় এখানে দেশী বিদেশী পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত থাকে। বান্দরবান জেলা প্রশাসনের পরিচালনায় শৈলপ্রপাতে নির্মাণ করা হয়েছে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় বিভিন্ন স্থাপনা।
নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র

সেখানে সময় কাটিয়ে দ্বিতীয় গন্তব্য নীলগিরি। যাওয়ার পথে রাস্তের দু’ধারেই পাহাড়, পাহাড়ের বুকে অসংখ্য কলাগাছের চাষ হয়। পথিমধ্যে পরিশ্রমী পাহাড়ি মানুষদের দেখা যায়। অনেকের হাতে দেখা যায় দা-কোদাল। এক লেনের রাস্তায় তীব্র গতিতে ছুটে যায় চান্দের গাড়ি।
বান্দরবান জেলা সদর থেকে প্রায় ৪৭ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্ব দিকে বান্দরবান-থানছি সড়কে পাহাড় চূড়ায় নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র অবস্থিত। সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে এর উচ্চতা ২ হাজার ২ শত ফুট। এখানকার প্রকৃতির কারুকাজ সবাইকে মুগ্ধ করে । এই রোদ, এই বৃষ্টি, আকাশে মেঘের গর্জন সেই সাথে রংধনুর হাসিমাখা আলোক রশ্মি, বাতাসের সাথে ছন্দ আর তাল মিলিয়ে প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় এই পরিবর্তনের এই পরিবর্তনের দৃশ্যগুলো পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।
এই পাহাড়ের চূড়ায়ই আছে সেনাবাহিনী পরিচালিত বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর পর্যটনকেন্দ্রগুলোর একটি ‘নীলগিরি পর্যটনকেন্দ্র’। এখানে সেনাবাহিনীর চেক পোস্ট থাকায় সবাইকে গাড়ি থেকে নামিয়ে চেক করে ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হয়। এখানে মেঘদূত, আকাশনীলা, নীলাঙ্গনা, মারমা হাউজসহ নানা নামের আকর্ষীয় কটেজ রয়েছে। আছে একটি ক্যাফেটেরিয়া।
দিনের বেলায় এই স্থান থেকে খালি চোখে বঙ্গোপসাগর ও জাহাজ চলাচলের দৃশ্য দেখা যায়। এছাড়া ছোট ছোট পাহাড়ের কোল ঘেয়ে বয়ে যাওয়া সাঙ্গু নদীর আঁকাবাঁকা দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য সকলকে আকর্ষণ করে।
প্রকৃতির অপরূপ মনোমুগ্ধকর নয়নাভিরাম এই দৃশ্যগুলি পর্যটকদের স্মৃতিতে ধরে রাখার জন্য অত্যন্ত চমকার একটি স্থান। এই স্থানটি অনেকের নিকট বাংলার দার্জিলিং নামে পরিচিত। এই পর্যটনকেন্দ্রে ঢুকতে টিকিট বাবদ জনপ্রতি ৫০ টাকা ও গাড়ির জন্য আলাদা ৩০০ পার্কিং ফি নেওয়া হয়।
সাঙ্গু নদী

নীলগিরি ভ্রমণ শেষ করে রওনা দিতে পারেন শহরের দিকে। তখনই পথিমধ্যে পড়ে চিম্বুক পাহাড় ও মেঘলা। আর ২০-২৫ কিলোমিটার পাড়ি দিলেই পাহাড়ি সাঙ্গু নদী উঁকি দেয়। মন পাগল করা, অদ্ভুত সুন্দর এক পাহাড়ি নদী! পাহাড়ের কোল বেয়ে এঁকে-বেঁকে চলছে কোথাও উন্মত্ত আবার কোথাও বা শান্ত এই নদী । মায়ানমারের আরাকান রাজ্যের পাহাড় থেকে শুরু করে বান্দরবানের ভিতর দিয়ে ১৭৩ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে অবশেষে কর্ণফুলী হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে । ইচ্ছে করলেই স্বল্প খরচে নৌকা বা বোট যোগে নৌকা ভ্রমণে যাওয়া যায়।
কী মনোলোভা! মিলনছড়ি পর্যন্ত সাঙ্গুর এমন কোমনীয় দৃশ্য মন ভরিয়ে দেবেই। এরপরেই চিম্বুক পাহাড়।
চিম্বুক পাহাড়

বান্দরবান জেলা শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম পাহাড় চিম্বুক পাহাড়ের অবস্থান। বান্দরবান সদর উপজেলার সদর ইউনিয়নের আওতাভুক্ত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ২৫০০ ফুট। চিম্বুক বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম পর্বত। একটু উপরে উঠতেই চোখ ছানাবড়া। পাহাড় আর পাহাড়! আহা, কী সুন্দর।
মনে হবে পুরো বাংলাদেশকে চিম্বুক পাহাড়ে দাঁড়িয়ে এক মুহূর্তে উপভোগ করতে পারবেন। এত সুন্দর আমাদের এই দেশ, চিম্বুক পাহাড়ে না এলে জানা যাবে না। এ পাহাড় থেকে সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয়ের দৃশ্য যেকোনো পর্যটককে মুগ্ধ করবে।
মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স

বান্দরবান- কেরানীহাট সড়কের পাশে পাহাড়বেষ্টিত স্বচ্ছ জলোর মনোরম লেকে মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স। বান্দরবান শহর থেকে ৪.৫ কিলোমিটার দূরে এই কমপ্লেক্সে রয়েছে চিত্তবিনোদনের নানাবিধ উপকরণ। জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে একটি চিড়িয়াখানাসহ পর্যটন কেন্দ্রটি পরিচালিত হচ্ছে। প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ৩০ টাকা
নীলাচল পর্যটন কমপ্লেক্স

তৃতীয় ভ্রমণের স্থান হলো নীলাচল। এটি বাংলাদেশের বান্দরবান জেলায় অন্যতম দর্শনীয় স্থান। এখানে নীলাচল পর্যটন কমপ্লেক্স বান্দরবান জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে টাইগার পাড়া এলাকায় সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে ২০০০ফুট উচ্চতায় গড়ে তোলা হয়েছে আকর্ষণীয় এই পর্যটনকেন্দ্র।
নীলাচল থেকে আকাশ ছোঁয়া না গেলেও মনে হবে আকাশ আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মেঘের রাজ্যে হারিয়ে যাবার স্বপ্ন যদি কারো থাকে তাহলে স্বপ্ন পূরণ হবে ‘‘ নীলাচল’’ গেলে। বর্ষায় সেখানে চলে রোদ আর মেঘের লুকোচুরি খেলা। শীতল পরশ বুলিয়ে শুভ্র মেঘ মুছে দেবে আপনার জীবনের ক্লান্তি। নীলাচল থেকে অনায়াসেই চোখে পড়বে বান্দরবান শহর। চার পাশে দেখা যাবে সারি সারি সবুজঘেরা পর্বতমালা। এখান থেকে ‘‘ চিম্বুক’’ পাহাড়ও দেখা যায়। আর রাতে দেখা যায় ‘‘ বন্দর নগরী চট্টগ্রামের ’’ রহস্যময় আলো আঁধারির খেলা। নীলাচলের কোল ঘেঁষেই রয়েছে তঞ্চগ্যা, মারমা ও ত্রিপুরা উপজাতিদের বসবাস। বান্দরবান জেলা প্রশাসন কর্তৃক ‘‘ নীলাচল পর্যটন কেন্দ্র টি’’ পরিচালনা করা হয়।
২০০৬ সালের পহেলা জানুয়ারি এই প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়। এ প্রকল্পে রয়েছে ‘শুভ্রনীলা’, ‘ঝুলন্ত নীলা’, ‘নীহারিকা’ ও ‘ভ্যালেন্টাইন পয়েন্ট’ নামে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় বিশ্রামাগার। কমপ্লেক্সের মাঝে বাচ্চাদের খেলাধুলা ও বসার ব্যবস্থা আছে।

পাহাড়ের ঢালে ঢালে সাজানো হয়েছে এ জায়গাগুলো। ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে সামনের পাহাড়ের দৃশ্যও ভিন্ন রকম। একটি থেকে আরেকটি একেবারেই আলাদা, স্বতন্ত্র। এই স্থানে বর্ষা, শরৎ কি হেমন্ত- তিন ঋতুতে ছোঁয়া যায় মেঘ। নীলাচল থেকে সমগ্র বান্দরবান শহর একনজরে দেখা যায়।
মেঘমুক্ত আকাশে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের অপূর্ব দৃশ্য নীলাচল থেকেই পর্যটকরা উপভোগ করতে পারেন। নীলাচলের বাড়তি আকর্ষণ হলো সেখানকার নীলরঙা রিসোর্ট। নাম ‘নীলাচল স্কেপ রিসোর্ট’। সাধারণ পর্যটকদের জন্য এ জায়গায় সূর্যাস্ত পর্যন্ত অনুমতি আছে। সকালে নীলাচলে মেঘের খেলা দেখলে কারো মন চাইবে না আর বাড়ি ফিরতে।
নীলাচলে চারদিকের সবুজ গাছপালা, শীতল আবহাওয়া, বিভিন্ন রঙিন গাছ ইত্যাদি। সব কিছু মিলে নীলাচল যেন বাংলাদেশের জন্য এক অপরূপ দান। এত সুন্দর হতে পারে পাহাড়! যদি নীলাচল কেউ না আসে সে কখনো বুঝবে না। পরিবেশ আর আবহাওয়ার এতটা মিল কীভাবে হয়! নীলাচলের সৌন্দর্য ভাষায় ব্যাখ্যা করা সত্যিই কঠিন।
আরও দেখুন: